Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা ও অর্ধশতাব্দীর সমবায় আন্দোলন

বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা ও অর্ধশতাব্দীর সমবায় আন্দোলন
ড. জাহাঙ্গীর আলম
বাংলাদেশ মহান স্বাধীনতার ৫০তম বছর অতিক্রম করেছে। একই সঙ্গে উদ্যাপিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এর ফলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী একাকার হয়ে মিশে গেছে। আমাদের জাতির পিতা গ্রাম থেকে এসেছেন, গ্রামের    কৃষকদের সংস্পর্শে থেকে তাদের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। বলেছেন, ‘আমিতো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালোবাসি।’  স্বাধীনতার পর ওই গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন এবং কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তিনি কৃষি বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য তিনি উদার রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এ দেশের কৃষি ও কৃষকের এক মহান প্রাণ-পুরুষ, পরম বন্ধু। দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের কথা ভেবে তিনি ডাক দিয়েছিলেন সমবায় আন্দোলনের। এর মাধ্যমে তিনি কৃষির উৎপাদন বাড়াতে চেয়েছেন। সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে চেয়েছেন। সমবায়ের মাধ্যমে তিনি আর্থিক সমস্যার সমাধানসহ সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা, সু-আচরণ ও আত্মসহায়তাবোধ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। ১৯৭২ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সম্মেলনে ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষী গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে। জোতদার ধনী চাষির শোষণ থেকে তারা মুক্তিলাভ করবে সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একইভাবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উৎপাদনের মাধ্যম একত্র করতে পারেন, তবে আর মধ্যবর্তী ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না। সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামবাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প, যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত দুঃখী মানুষ। সমাজতন্ত্র স্থাপনের জন্য আমরা ইতোমধ্যেই সমস্ত বড় শিল্প, ব্যাংক, পাটকল, চিনিকল, সুতাকল ইত্যাদি জাতীয়করণ করেছি। জমির সর্বোচ্চ মালিকানা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আজ সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামে গ্রামে, থানায়, বন্দরে গড়ে তুলতে হবে মেহনতি মানুষের যৌথ মালিকানা। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল ভোগের ন্যায্য অধিকার।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেছেন, ‘আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী জনতার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। আপনারা জানেন আমি ঘোষণা করেছি যে সংস্থার পরিচালনা-দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর, কোনো  আমলা বা মনোনীত ব্যক্তির উপরে নয়। আমার সমবায়ী ভাইয়েরা এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপকে অভিনন্দিত করেছেন। এই গণতন্ত্রীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তাদের দায়িত্ব। তাদের দেখতে হবে যে সমবায় সংস্থাগুলো যেন সত্যিকারের জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠে। জেলে সমিতি, তাঁতী সমিতি, গ্রামীণ কৃষক সমিতি যেন সত্যিকারের জেলে, তাঁতী, কৃষকের সংস্থা হয়-মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী বা ধনী কৃষক যেন আবার এই সমিতিগুলোকে দখল করে অতীত দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি না করে’।
বঙ্গবন্ধু সমবায় আন্দোলনকে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। একে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপায়িত করতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমেই তিনি সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় সমবায়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন এবং দেশের জনগণকে সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন, ধ্যান, ধারণা ও আরাধনার ধন। আর সে সোনার বাংলা ঘুমিয়ে আছে চির অবহেলিত গ্রামের আনাচে-কানাচে, চির উপেক্ষিত পল্লীর কন্দরে কন্দরে, বিস্তীর্ণ জলাভূমির আশেপাশে আর অরণ্যের গভীরে। ভাইয়েরা আমার, আসুন সমবায়ের জাদুস্পর্শে সুপ্ত গ্রাম বাংলাকে জাগিয়ে তুলি।’
স্বাধীনতার পূর্বে ষাটের দশকে এ দেশে সমবায় আন্দোলন তেমন জোরদার ছিল না। সমিতির সংখ্যা ছিল হাতে গুণা।  সদস্য সংখ্যা ছিল খুবই কম। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সহায়তায় গ্রামীণ ক্ষুদ্র ঋণ ও কৃষি সমবায় প্রসারিত হচ্ছিল দেশের সীমিত কিছু এলাকায়। পানি সেচ ও উচ্চফলনশীল ফসলের আবাদ উৎসাহিত করা হচ্ছিল বিভিন্ন গ্রামে। সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প। তখন দেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে এসবের প্রভাব ছিল খুবই কম। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমবায় আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। ১৯৭২ সালে প্রণীত দেশের সংবিধানে সমবায় মালিকানাকে দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বন্টনপ্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা-ব্যবস্থা নি¤œরূপ হইবে। (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে  রাষ্ট্রের মালিকানা; (খ) সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং (গ)  ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা’।
বঙ্গবন্ধু দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে সমবায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এর সদস্য হতো গ্রামের সব মানুষ। তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যৌথ কৃষি খামার। সরকার তাতে ঋণ দেবে, উপকরণ সহায়তা দেবে, সেচের ব্যবস্থা করে দেবে। তাতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে। তার সুফল পাবে জমির মালিক, শ্রম প্রদানকারী ভূমিহীন কৃষক ও সরকার। তবে জমির মালিকানা কৃষকেরই থাকবে। এ ক্ষেত্রে ভয় না পাওয়ার জন্য কৃষকদের তিনি আশ্বস্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে পাঁচ বছরের প্ল্যান, প্রত্যেকটি গ্রামে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে। বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রাম কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেক মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ...ভুল করবেন না। এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি, তাতে আমি আপনাদের জমি নেবো না। ভয় পাবেন না যে জমি নিয়ে যাব, তা নয়। এ জমি মালিকের থাকবে। আপনার জমির ফসল আপনি পাবেন। কিন্তু ফসলের অংশ সবাই পাবে। ...এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে, আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এজন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল দেশদ্রোহী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায়ের রূপরেখা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু সমবায় আন্দোলন থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেরণায় সমবায় কর্মসূচি পুণরায় গতি লাভ করে। বর্তমানে এ দেশে ২৯ প্রকারের সমবায় সমিতি রয়েছে। মোট সমিতির সংখ্যা ১,৯৭,০৬৫টি। তাতে অংশগ্রহণকারী সদস্য সংখ্যা ১,১৭,৪২,৬৭৪ জন।  এদের একটি বড় অংশ কৃষি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কৃষি পণ্যের উৎপাদন করছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের নাগপাশ এড়িয়ে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছে। সমবায়ের মাধ্যমে তারা উন্নত বীজ, সার, সেচ ও কৃষি যন্ত্রায়নের ব্যবস্থা করছে। এক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই দেশের কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে অধিক উৎপাদন ও লাভজনক বিপণনে উৎসাহিত করেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৩.০৯ শতাংশ হারে এবং সদস্য সংখ্যা ২.৮২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমানত ও কার্যকরী মূলধনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৬.৭০ এবং ৯.৭১ শতাংশ (সারণি-১)। বর্তমানে সমবায় খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৯,৬৩,৮৯২ জনের। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ সূচিত হয়েছে দেশের সমবায় খাতে।
গত ৫০ বছরে দেশে কৃষির উৎপাদন প্রায় ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দুধ, ডিম, মাংস ও মাছের উৎপাদন। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় খাদ্যে সয়ম্ভর। ধানের উৎপাদন বেড়েছে  প্রতি হেক্টর ১ টন থেকে ৩ টনে। উচ্চফলনশীল জাত সম্প্রসারিত হয়েছে শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে। সেচ এলাকা বিস্তার লাভ করেছে ৭৪ শতাংশ ফসলি এলাকায়। এতে সমবায়ের প্রভাব রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের কৃষির উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়াতে হবে। বিভিন্ন কৃষি পণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এর জন্য সমবায় আন্দোলনকে আরও জোরদার করা দরকার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতি গ্রামে যৌথ  কৃষি খামার গড়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। এর বণ্টন ব্যবস্থা হতো তেভাগা পদ্ধতির। ভাগ পাবে জমির মালিক, শ্রমিক ও সমবায়। এ বিষয়ে ৭০ এর দশকের প্রথম দিকে বেশ কিছু মাঠ পর্যায়ের গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ময়মনসিংহের শিমলা, কুমিল্লার বামইল, রাজশাহীর গুরুদাসপুর এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া গুমাইবিল প্রকল্প। গবেষণায় দেখা গেছে ফলাফল ইতিবাচক। তাতে উৎপাদন বেড়েছে। শ্রমিক তার মজুরি পেয়েছে বেশি। গ্রামীণ আয়ের বণ্টনে উন্নতি হয়েছে। বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে যৌথ খামার কর্মসূচি আর এগিয়ে যেতে পারেনি। তবে সার্বজনীন ও সর্বাঙ্গীণ গ্রাম উন্নয়ন তথা কৃষি উন্নয়নের জন্য তা আজও প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি সমবায় বিভাগ প্রণীত বঙ্গবন্ধু মডেল ভিলেজ প্রকল্প তা মাঠপর্যায়ে প্রতিপাদন করতে পারে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনপ্রতি আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলারের নিচে। অর্ধশতাব্দী পর এখন তা উন্নীত হয়েছে ২,৫৯১ মার্কিন ডলারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গত ১৩ বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ হারে। ১৯৭২ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশ। একটি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে এসে স্থান করে নিয়েছে। তবে আয় বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং তার অবনতি ঘটেছে। ২০২০ সালে আয় বণ্টনের গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, সেটি ২০১৮ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ০.৪৮। এটা মাঝারি বা পরিমিত পর্যায়ের আয়বৈষম্য হিসেবে বিবেচ্য। গিনি সহগ ০.৫ এর উপরে গেলে তা হবে উচ্চ আয় বৈষম্যের নির্দেশক। আমরা সেই ক্রান্তিকালে আছি। অতএব, এ বৈষম্য কমাতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে আয়বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নের প্রতি সমবায়কে যতœবান হতে হবে।
বর্তমানে মানুষে মানুষে বৈষম্য বিরাজমান। বৈষম্য রয়েছে গ্রাম ও শহরের জীবন ধারায়। এগুলো দূর করতে হবে। এর জন্য দরকার গ্রামীণ অর্থনীতিকে বহুমুখী করা, কর্মসংস্থান বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করা, পুঁজি গঠন ও আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ করা, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা, বাসস্থানের সংস্থান বাড়ানো ইত্যাদি। সমবায়ের মাধ্যমে তা কার্যকরভাবে সম্পাদন করা সম্ভব। রূপকল্প ২০২১ এর প্রধান লক্ষ্যগুলো ছিল উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ লক্ষ্যগুলো অর্জনে আমরা পুরোপুরি সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে রূপকল্প ২০৪১ অনুসারে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ। তখন জনপ্রতি আয় দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। নিরষ্কুশ দারিদ্র্য দ্রুত বিলুপ্ত হবে। চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটবে। দেশের নাগরিকদের কোন অভাব থাকবে না।  এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব  রাখতে পারে সমবায়।  অতএব রূপকল্প ২০৪১ এর বাস্তব রূপায়ন ও আয়বৈষম্য হ্রাসের জন্য সমবায়কে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।
বাংলাদেশের ক্ষেতে-খামারে দ্রুত উৎপাদন বাড়ছে। তাতে সমস্যা বাড়ছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বিপণন প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া ও ব্যবসায়ী। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের উৎপাদন মৌসুমে ধানের মূল্য থাকে প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। পরে তা ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় বৃদ্ধি পায়, তখন কৃষকের ঘরে আর বিক্রিযোগ্য ধান থাকে না। এর লাভ পুরোটাই নিয়ে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, চালের আড়তদার ও চাতালের মালিকরা। তাছাড়া বেগুন উৎপাদন করে শেরপুরের কামারের চরের কৃষকরা প্রতি কেজি বিক্রি করে ৮ থেকে ৯ টাকায়। ঢাকায় তা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় ৫০ টাকায়। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। ঢাকায় তা কিনতে হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে। সিরাজগঞ্জের বাঘা বাড়িতে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে মিল্ক ভিটার মাধ্যমে দুগ্ধ বাজারজাত করণের সুবিধা থাকার জন্য। সুনামগঞ্জের হাওরে সেই সুবিধা নেই, দুধের উৎপাদনেও তেমন লক্ষণীয় কোন উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কাজেই দেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য লাভজনক বিপণন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমবায়ের মাধ্যমে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক বিপণনের বহু উদাহরণ আছে। ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, ভারত সবত্র সমবায়ভিত্তিক বিপণনের প্রাধান্য রয়েছে। নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কৃষিজাত পণ্য সমবায়ের মাধ্যমে  দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে এর অবস্থান দুর্বল। এ ক্ষেত্রে আর্থিক উন্নয়ন এবং সমবায়ভিত্তিক বিপণন ও উৎপাদনের পর্যাপ্ত সুযোগ বিদ্যমান।
নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটি অগ্রগামী দেশ। বিশে^র অনেক দেশের কাছেই এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষা, গবেষণা, রাজনীতি, প্রশাসন, পররাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সমবায় সমিতিতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনও কম। বাংলাদেশে মোট সমবায়ীর সংখ্যা ১ কোটি ১৭ লক্ষ ৪৩ হাজার। এর মধ্যে ২৩/২৪ শতাংশ নারী। এটা বাড়াতে হবে। দেশের অনেক অনানুষ্ঠানিক সমবায় সমিতির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের হিস্যা ৭০/৮০ শতাংশ। অনুষ্ঠানিক সমবায়ের ক্ষেত্রেও তা অনুসরণযোগ্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন”। সমবায়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
চিরায়ত সমবায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য ক্ষুদ্র ঋণ উদ্ভাবন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ দেশে চালু রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ ও সঞ্চয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি, প্রাথমিক কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন এবং প্রাথমিক কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সমবায় সমিতি ইত্যাদি ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে এ ধরনের সমিতির সংখ্যা ১২,৩৮১। সদস্য সংখ্যা ১৪,৪২,৫১৩ জন। এরা নিজেরা সঞ্চয় করে, ঋণও দেয়। চীনে শতকরা ৮৫ ভাগ কৃষি ঋণ সমবায়ভিত্তিক। বাংলাদেশেও এর সম্প্রসারণ ঘটছে। তবে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। এর প্রতিকারও আছে। গণতন্ত্রায়ন ও স্বচ্ছতা সমবায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে দুর্নীতি থাকবে না।
বর্তমান বিশে^র মানুষ এক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার অভিযাত্রী। এখানে পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রধান অবলম্বন সমবায়। আমাদের দেশের সমবায় চিন্তকদের অবশ্যই ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের স্বার্থে কাজ করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নিশ্চিত করার একটি কৌশল হচ্ছে সমবায়। এটি শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়। মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের নির্ভরযোগ্য একটি অবলম্বন সমবায়। এটি সততা প্রতিষ্ঠা এবং মনন ও মানসিকতা পরিবর্তনের উত্তম পন্থা। সমবায় সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রান্তিক জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যাবে। এর জন্য দেশে সমবায় আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় ‘দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমবায় একটি পরীক্ষিত কৌশল।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০,  ই-মেইল :almj52@gmail.com


COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon